জন্মদাগ ২৭

যতদূর দুচোখ যায় - যাক জন্মদাগ লেখা থাক - চারতলা ছাদে পাঁচিলে গাছের ঝুরি আর অপয়া আকাশে আটকে থাকা ঘুড়ি কেটে গিয়ে লাট খেয়ে হারিয়ে গিয়েছে বাইশ বছর আগে আমি তাই আড় বাঁশি নিযে পথ চলি সপ্ত সাগর আর মধ্যবিত্ত অলি গলি পেরিয়ে পানসি চালাই জোর টাইম স্কয়্যারে এইভাবে এপথ সেপথ ঘুরে বিপথে প্রান্তিক স্টেশনে এসে দাঁড়ায় জীবন চোখ খুলতেই দেখি চেনা সব কিছু আঁচল ভর্তি করে কত মাধুকরী যতদূরে দুচোখ যায় - যাক আমার জন্মদাগ ওই শহরের নাভিকুন্ডলীর পাশে হেসেখেলে বেশ শুয়ে আছে ডালাস 

জন্মদাগ ২৮

ঠিক সেসময় উড়িয়ে দিলাম হাওয়া ঠিক যেমনি খাঁচার পাখি মুক্ত করেন রাজা ঠিক সেসময় চলকে উঠল রোদ লোভীর মতন গড়িয়ে পড়ল ঠোঁটের ওপাশ দিয়ে ঠিক সেসময় ডাক পাঠাল হারানো চিঠিখানি যেমন করে মধ্যরাতে বিশুপাগল নিশির ডাক ডাকে ঠিক সেসময় হারিয়ে যেতে যেতে বৃষ্টি ভেজা ক্লান্ত তাহার মুখ - মিলিয়ে গেল মেঘের বুকে নিরুদ্দেশে - প্রান্ত স্টেশন রোডে ঠিক সেসময় পাখিরা মেলেছে ডানা ঠিক সেসময় ভোরেরা আজান দেয় আর সেসময় পরম আদরে আমার বুকের কাছে অন্য আরেক সময় ঘুমিয়ে আছে ডালাস 

জন্মদাগ ২৯

এই জন্মে অনেক কথা রাখা হল না পাড়ার মাঠে বৃষ্টি হলে কাদার আদর মাথায় নিয়ে - খেলার শেষে টিউবওয়েলে আদ্যোপান্ত শুদ্ধ হয়ে শাঁখ বাজবার আগেই ফিরে পড়তে বসে ঢুলে পড়তাম তুমি তখন চুলে মাথায় ঠাণ্ডা হাত বুলিয়ে দিয়ে বড় হতে মানুষ হতে ভালো হতে বলেছিলে - সেসব কথা মনে রইল - এই জন্মে রাখা হল না একসঙ্গে পথ চলতে - হাত ধরতে শিখেছিলাম শক্ত করে ধরে রাখতে শিখেছিলাম চোখ নামিয়ে মৃদুস্বরে বলেছিলে - " তুমিই আমার প্রথম পুরুষ - সঙ্গে থেকো - হাত ছেড়ো না " সেই দুটি চোখ হারিয়ে গেছে তারার মত সেই হাত আর শক্ত মুঠো আলগা হয়ে মিলিয়ে গেছে হাওয়ার সাথে - অন্য কোনও বিদেশ গেছে - সেসব কথা মনে রইল - এই জন্মে রাখা হল না শহর যখন ভীষণ কাঁদছে - একসঙ্গে কান্না শুনতে শিখেছিলাম - মিছিলের সেই মুখটি নিয়ে - আকাশ বাতাস এলোপাথাড়ি স্বপ্ন দেখতে - শিখেছিলাম বলেছিলাম - " শহর তুমি বন্ধু আমার - তোমার জন্য জীবন বাজি " সেসব কথা মনে রইল - এই জন্মে রাখা হল না এই জন্মে অনেক কথাই রাখা হল না অনেক পাপের শোধ হল না সেসব নিয়ে তোমার কাছে ফিরে আসব আবার করে ফিরে আসব আসতে দেবে ? ডালাস 

জন্মদাগ ৩১

যে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে - থাক যার শরীরে আগুন জ্বলে - জ্বলুক বৃষ্টি পড়ুক যেখানে মেঘের মন যার যে যে রঙ মন্দ লাগে - লাগুক আমি তাঁদের ছায়ার সঙ্গে থাকি আকাশকে বলি মন্দসূখের কথা লুকিয়ে রাখি মাঝবয়েসের সাধ বুকপকেটে - শিশুকালের মতন আমি তাঁদের অন্ধকারের সাথী দৌড় দৌড় - ভূবন ডাঙ্গার মাঠ যেখানে কেউ যায় নি সাহস করে যেখানে কেউ যায় না কারুর সাথে যে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে - থাক আমি তাঁদের ছায়ার সঙ্গে থাকি অসাবধানী স্মৃতির আবডালে পরম যত্নে কেবল ছুঁয়ে থাকি ডালাস 

জন্মদাগ ৩২

আমি যাকে চিনতাম তার নাম লেখা ছিল তারাটির মধ্যকপালে দিক ভূল হলে অচেনা রাস্তার মোড়ে ছাই রঙা গাড়ি এসে ডেকে নিয়ে যেত ঊর্ধ্বশ্বাসে পৌঁছে দিত চেনা গলিটিতে নরম আশ্রয়ে আমি যাকে চিনতাম তার নাম তোমার নামের সঙ্গে মিলে যেত বলে সব কিছু ভূলে নিশির ডাকের মত পালিয়েছি একসাথে অন্য শহরে আমি যাকে চিনতাম তার নাম কাগজের প্রতিটি পাতায় লেখা হত শপথের মত আর মন্ত্রের সূরে আমি যাকে চিনতাম তার নামে - মিলিয়ে রেখেছি নাম তার আমি যাকে চিনতাম ... ডালাস 

জন্মদাগ ৩৪

ফুটবল ম্যাচে হেরে গিয়ে ঠোঁট চেপে বাড়ি ফিরে মিথ্যে বলেছি বহুবার গলা কাঁপে নি একবার ও শুধু রাত্রিবেলা ভিজে গিয়েছে বালিশ ইংরেজীতে ফেল করবার পর চড় আছড়ে পড়েছে গালে রাগে রি রি করে জ্বলেছে শরীর - তবু চোখ ফেটে জল আসে নি এক ফোঁটা ও আর রাত্রিবেলায়, মায়ের ঠাণ্ডা হাত যখন এলোমেলো করে দিচ্ছে মাথার চুল, আমি বুকভাসানো কান্নার সূখ স্পর্শ করতে শিখেছি সারা রাত জেগে লেখা পোস্টার যখন পরের দিন ছিঁড়ে কুটি কুটি হয়ে নর্দমায় ভেসে গেছে তখন নয় কলেজ ইউনিয়নে হেরে যাবার পরেও নয় এমনকি পুলিশের থাপ্পড় খাবার পরেও নয় কিন্তু চেনা বন্ধুটি যেদিন অচেনার ভান করে চলে গেল আমি কৈশোর পেরিয়ে বড় হয়ে গেলাম শিখলাম চোখের জল জমিয়ে রাখতে হয় শেষ ট্রেনে বাড়ি ফেরবার জন্য তারপর তুমি এলে সন্ধ্যায় তারা উঠলো আকাশ জুড়ে জোনাকীর আলোয় মহা ধুম ধাম করে আকণ্ঠ নাচ গান হল - মাদল বাজল - আর উল্লাশ যখন পূর্ণিমার মত উজ্জ্বল ঠিক তখনই কালবৈশাখী হাওয়া এসে উড়িয়ে নিয়ে গেল আমাদের - একরাশ ধুলোর মত ছুঁড়ে ফেলে দিল পৃথিবীর অন্য কোনায় - অন্য পাঠশালায় আর সেইদিন থেকে আমি যৌবনের লোনা জলে ভাসতে শিখলাম এখন মধ্যরাতে ঘুম ভাঙে সন্তানের গায়ের চাদর ঠিক করে দিই মাথার চুলে বিলি কাটি আনমনে ছুঁয়ে থাকি যতক্ষণ ছুঁয়ে থাকা যায় যেমন করে আমায় ছুঁয়ে থাকতো আমার মা আমার সন্ধ্যাতারা, শেষ ট্রেন বনগা লোকাল সাগরের লোনা জলে প্রশান্ত হয়েছে বহুদিন দৌড়বার মতো কিছু বাকি নেই - বিস্ময় ও নেই বলবার মতো কিছু নেই আর শুধু জানলার বাইরে অপেক্ষারত অমাবস্যা আর তার সঙ্গে অবান্তর আলাপচারিতার অভ্যাস ডালাস 

জন্মদাগ ৩৫

তুমি হারিয়ে ফেললেও আমি জমিয়ে রেখেছি চিঠি ডাকটিকিট আর সবুজ ফাউন্টেন পেন অসাবধানে পড়ে যাওয়া কয়েকটি কালির ফোঁটা আর সারা রাত বার বার পড়ে ফেলা অক্ষরমালা তুমি হারিয়ে ফেললেও - আমি জমিয়ে রেখেছি সব কিছু তুমি চোখ সরিয়ে নিলেও আমি একঘেয়ে সূরের মতো তোমার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াই এর ওর সাথে কথা বলি ঝগড়া করি - পুতুলের বিয়ে দিই সন্ধ্যায় শঙ্খ বাজিয়ে ডাক দিই তুমি চোখ সরিয়ে নিলেও আমি সেই একঘেয়ে সূর হয়ে বাজতেই থাকি তুমি নিমন্ত্রন না করলেও আমি ঠিক চলে আসি আলপনা আঁকি একমনে কপালে চন্দন - শরীরে ফুলের অলঙ্কার পরাই শয্যা সাজিয়ে রাখি যাতে কোনো ত্রুটি না হয় তুমি নিমন্ত্রন না করলেও ... আমি সবাইকে ডেকে নিয়ে আসি তুমি ভূলে গেলেও আমি কিছুতেই ভূলতে পারি না সেই সব অঙ্গীকার - অসম্ভব দাবী চেনা হাতে হাত রেখে - চেনা বিস্বাসে - নিস্বাস নেওয়া তুমি ভূলে গেলেও আমি কিছুতেই ভূলতে পারি না সেই সব আর দিন শেষ হয়ে এলে তুমি চলে যেতে বললেও আমি বার বার ফিরে আসি যেমনটি ফিরে আসে শৈশবের স্মৃতি, বালক বেলার মাঠ হারিয়ে ফেলা বাসের টিকিট আর সন্ধ্যার আবছা কুয়াশা ... তুমি চলে যেতে বললেও ... আমি বার বার - ফিরে আসি - অভ্যাসে - অসহায় ভাবে - ভালবেসে -... ডালাস 

জন্মদাগ ৩৬

তুমি তোমার মায়ের চোখের দিকে তাকাও দেখবে চালশে পড়া দৃষ্টি এখনোও পুরোন হয়ে যাওয়া স্বপ্ন দেখেই চলেছে আর পুরু চশমার ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে পড়া অন্তহীন স্নেহ শুধু তোমার জন্য তুমি তোমার বাবার চোখের দিকে তাকাও দেখবে তোবড়ানো গাল আর ক্ষয়াটে কপালের ভাঁজে চেনা সময়ের অনেক অজানা কথা লেখা রয়েছে যা আগে জিজ্ঞেস করতে শেখো নি - সেই সব গোপন আখ্যান তুমি তোমার বন্ধুর চোখের দিকে তাকাও দেখবে কি অসম্ভব বিশ্বাস নিয়ে সে তোমায় ছুঁয়ে রয়েছে তারপর তুমি শহরের চোখের দিকে তাকাও দেখবে তুমি আসবে বলে কাল সমস্ত রাত বৃষ্টি হয়ে ধুয়ে রেখেছে রাজপথ মালা আর চন্দন নিয়ে বাতাসের ইশারায় ভর করে কত বছর ধরে কত যন্ত্রণা নিয়ে সে তোমার জন্য অপেক্ষায় বসে আছে তুমি তোমার বাবা, মা, বন্ধু আর নিজের শহরের চোখের দিকে তাকাও আর তারপর আয়নায় নিজের দিকে তোমার লজ্জা করে না ? ডালাস 

জন্মদাগ ৩৭

এই জলটি সেই নদীটির চোখের জলের খবর জানে যে পাত্রে রাখলে তাকে পাত্রখানি নিজের করে তাকেই বুকে জড়িয়ে ধরে ফুল ফোটালো চাঁদকপালে টিপ পরালো যত্ন করে নৌকো গড়ে জোয়ার টানে ভাসিয়ে দিলে অথচ তার শরীর জুড়ে উজানের সূর বাঁধ মানে না পদ্মপাতায় জল সরে না যেখানেই তার ঠিকানা হোক সে কেবলই জড়িয়ে থাকতে শিখেছিল বাবার কাছে মায়ের কাছে এবং রাজপথের কাছে এবং রুক্ষ হাওয়ার কাছে যেখানেই থাক, সন্ধ্যাবেলায় বাড়ি ফিরতে শিখেছিল এই জলটি সেই নদীটির সঙ্গে থাকে চোখের জলের খবর রাখে ডালাস 

জন্মদাগ ৩৮

তুমিই তো বলেছিলে ঈশ্বরীর কথা লাল পাড় শাদা শাড়ি কপালে আগুন আর মধ্য গঙ্গায় ঝড় অবান্তর জ্বলে পুড়ে খাক হল বসতী বান্ধব মরে গেল একা একা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া বালকের চোখ তাকাতে পারি নি আমি - তাই সেই পাড়ানির কড়ি গুনে গেঁথে জমিয়ে রেখেছি এতোদিন - এতো - দিন সুখে আর শান্তিতে ছায়ার বিজ্ঞাপনে ঘুমিয়ে রয়েছি কুম্ভকর্ণের মত তুমি বলেছিলে বলে ঈশ্বরীর কানে কানে জপমালা শুধু তুমি বলেছিলে বলে সমস্ত যৌবন পেতে সাজিয়েছি শান্তি আর স্বস্তির থালা শুধু তুমি বলেছিলে বলে !!! এইবার সূর্য ক্লান্ত হল ফুরালো হিসাবের খাতা শরীরে ছায়ার গন্ধ - পায়ে বিস্মরন আমি তাই নতজানু প্রার্থনায় বসি অপরাহ্ন শান্তি নয় রসাতল দাও প্রভূ একবার চেটে পুটে খাই ডালাস