ফেটে যাওয়া জলের পাইপ আর অনাবিল বৃষ্টির জল মিলে মিশে একসাথে বয়ে চলেছে এক অচেনা লক্ষের দিকে।
বাঁপাশে মানুষের ভিড় … বাজারী মানুষ প্রাত্যহিক বাজারশিল্পে মগ্ন … এক কিলো আলু, আড়াইশো পেঁয়াজ, পঞ্চাশ কাঁচালঙ্কা … কাতল কত করে গো? মানুষের ভিড় – কেজো মানুষেরা বাসস্টপে দাঁড়িয়ে … সুন্দর ইস্তিরি করা নির্ভাঁজ একরঙা জামা … চকচকে জুতো, ঘড়ি, চশমা, ব্যাগ এবং টাক … মাথায় চিন্তা। ইস্কুল যাত্রী মানুষের ভিড় – বইয়ের ভারে, কম্পিটিশনের ভারে, বাবা-মার পিয়ার প্রেসারের ভারে ভোরবেলায় চোখে মুখে অসহায় ক্লান্তি। মানুষের ভিড় … অকেজো মানুষের ভিড় ফুটপাথের জবরদখল পন্ডিতের চায়ের দোকানে … বয়স্ক তাই অকেজো … বয়স্ক তাই অঢেল সময় … বয়েস হয়েছে তাই মর্নিং ওয়াক সেরে চটজলদি বাড়ি ফেরার বিশেষ দায় নেই … । মানুষের ভিড় … ধান্দাবাজ এবং রাজনৈতীক মানুষের ভিড় … বাজারের কোনে পাড়ার মোড়ে পার্টি অফিসের বন্ধ দরজার সামনে কিসব জটিল হিসেব নিকেশে ব্যাস্ত …
আর ডান দিকে রেলব্রিজ … উঁচু হয়ে উঠে যাওয়া সভ্যতার অশনি সঙ্কেত … পাঁচ মিনিট দশ মিনিটে ছুটে যাচ্ছে শিয়ালদাগামী বাদুড়ঝোলা ট্রেন … কেউ উর্ধশ্বাসে … কেউ বা গজেন্দ্রগমনে … ঠিক ওখানটাতেই কিছুদিন আগে কে একটা কাটা পড়েছিল না? নাকি গলা দিয়েছিল ? কে জানে … কি দরকার জেনে ?
যত কম জানা যায় ততোই ভালো … বিশেষত গায়ে না লাগলে হাওয়া যতোই দিক তাতে কি আসে যায় …
আমরা আছি আমাদের তালে … ঝক্কি ঝামেলা কম? সকালে উঠে ঢুলু ঢুলু চক্ষে বাজারযাত্রা … গত রাতের খোঁয়াড়ি ভাঙে না … তাই হিসেব গুলিয়ে যায় … সব্জির দাম তো অ্যাবসার্ড রকম বেড়েই চলেছে… তায় আবার পেস্টিসাইড আর হর্মোন ইঞ্জেকশন দেওয়া … মাছের বাজারে তো ঢোকা যায় না … পকেটে টান … থুড়ি ফাঁক হয়ে যায়। আর মাঝে মধ্যে বুক ঠুকে ঢুকে পড়লেও লোভী লোভী চোখে মেরিলিন মনরোর মতো শুয়ে থাকা ইলিশ সুন্দরীর দিকে তাকাতে তাকাতে কাতলা, সিল্ভার কার্প, কাটা পোনার দরদস্তুর … হলিঊড না হোক আমাদের টলিউডি শতাব্দীই সই … এবং ঘন্টাখানেকের ইমোশনাল রোলার কোস্টার রাইড শেষ করে জয়-পরাজয়ের আধাআধি অনুভুতি গায়ে মেখে, বাইরে একফালি হাসি ঝুলিয়ে মাথার মধ্যে একঝলক রাগ নিয়ে বাড়ির পথে …
আমরা আছি আমাদের তালে … ঝক্কি ঝামেলা কম? কাজের লোক ঠিক সময় আসে না … ওদিকে দুধের গাড়ী এলো কি না … ছেলে মেয়েদের ডেকে তোলা … ওকে বাজারে পাঠানো … ফিরে আসলে বাজার তোলা … তার মধ্যে একঝলক খবরের কাগজে চোখ বুলিয়ে কেচ্ছা - কেলেঙ্কারিগুলো মাথায় ঢুকিয়ে নিয়ে আবার রান্না ঘরে ঢুকে যাওয়া … আর এই সবকিছুর মধ্যে এক মিনিটের শীর্ষ সম্মেলন … সন্ধ্যার প্ল্যান প্রোগ্রাম …
আমরা আছি আমাদের তালে … ঝক্কি ঝামেলা কম ? দুটো নাকে মুখে গুঁজে অফিস … ঠিক সময়ে বাস স্ট্যান্ডে… বেণী ঝুলানো ওই কলেজমেয়েটাও তো সেই সময় … দেখেও না দেখার ভান … দত্তবাবুর সঙ্গে দুটো রসের কথা … ট্রাফিক জ্যামের জটিল হিসেব নিকেশ … অতঃপর “সদাগরী অফিসের কনিষ্ঠ কেরাণী”-র চ্যাটার্জি ইন্টারন্যাশনালের পাঁচতলায় একফালি টেবিলের নিরাপত্তাবোধ।
আমরা আছি আমাদের তালে … ঝক্কি ঝামেলা কম? কাল রাতে দেড়টা অব্দি সোহিনির সঙ্গে কথা বলতে হয়েছে … ওর সঙ্গে কিন্নরের ব্যাপারটা খুব সেন্সিটিভ স্টেজে চলে গেছে … কি করে যে ঠিক করা যায়! … সিদ্ধার্থ অবিশ্যি অনেকটাই ম্যাচিওর্ড … আমার ব্যাপারটা বোঝে - অনেক ডাউন টু আর্থ … আসলে ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছেলে তো। কিন্নর টা ইডিয়েট … কাঁধে শান্তিনিকেতনী ব্যাগ ঝুলিয়ে সাহিত্য সাহিত্য করে বেড়ালে চলে? … সোহিনির ও তো একটা সহ্যের সীমা আছে না কি? সকালে আবার ফোন করবো ভেবেছিলাম… কিন্তু জরিনা মাসী না আসায় ঘর ঝাঁট দিতে হল … কি হয় একদিন ঘর ঝাঁট না দিলে? মা যদি একটু ইন্টেলেকচুয়্যাল হত !!!
আর দেখো … কারো কিছুতেই কিছু যায় আসে না …
যেমন ওই বাচ্চা ছেলেটা … বছর পাঁচেক বয়েস হবে … পরনে একটা শতঃচ্ছিন্ন হাফ প্যান্ট … আর ওর সঙ্গে একটা মেয়ে … কয়েক বছরের বড় হবে … প্রতিদিন ডাস্টবিন থেকে কুড়িয়ে নিচ্ছে সভ্যতার উচ্ছিষ্ট …।
না … রেলগাড়ি দেখে ওদের বিষ্ময় জাগে না … সম্ভবতঃ ওদের জন্ম রেল লাইনের ধারের বস্তির কোন একটা খুপরী ঘরে।
না … ওদের বাবা পুরোহিত নন… পালাও লেখেন না … সত্যি বলতে কি ওদের বাবার খোঁজ পাওয়া যাবে এমন মাথার দিব্যি কেউ দিতে পারবে না।
তবু হঠাৎ যখন আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামে … ফুটো ফাটা বাসস্ট্যান্ডটার তলায় ওদের ছোট্ট চড়ুইভাতি পন্ড হতে বসে আর ওরা চোখ বন্ধ করে বলতে থাকে “লেবু পাতায় করমচা … যা বৃষ্টি চলে যা …”
এই দৃশ্য সেলুলয়েডে ধরে রাখার নয় … সংবাদপত্রে ছাপার নয় … ইন্টারনেটে ব্লগ করার নয় …
আর এইসবের টুকরো ছবির গায়ে গা লাগিয়ে আমার শহরে সকাল হলো … আমি চারতলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে খবরের কাগজের খেলার পাতা আর চা একসঙ্গে গলাধ্বঃকরন করতে করতে তাতে স্নান করলাম … বলতে পারেন শুদ্ধ হলাম। কেজো না অকেজো কিম্বা সুন্দর না অসুন্দর - কোন দলে ফেলবো জানা যায় না কিন্তু স্পর্শটা বড় সুখের … এ শহর … এই ভোরের শহর বড় মায়াময় … রক্তমাংশে ভিড়ের পাওয়া না পাওয়ার একটা গতি আছে – অজান্তেই সেই শ্রোতে কাগজের নৌকোর মত ভেসে চলা …
আর আজ যখন আকাশ কালো করে বৃষ্টি নেমেছে, ফেটে যাওয়া জলের পাইপ আর সামাজিক বিশ্বায়নের বৃষ্টির বেনোজল মিলে মিশে একসাথে বয়ে চলেছে এক অচেনা লক্ষের দিকে, আমার শহরের … আমার মায়াময় শহরের অপু-দূর্গাদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে চারতলার ওপর থেকে ফিস ফিস করে বলি … “লেবু পাতায় করমচা … যা বৃষ্টি … চলে যা …“