এলোমেলো ফ্ল্যাটবাড়িতে খসে পড়া পলেস্তারার গায়ে শস্তা আকাশী পোঁচ– পুরোন আসবাবে ধুলো ঝেড়ে – জানলা দরজা পরিষ্কার করে – পুরোন আল্‌নায় পাট করা পায়জামা পাঞ্জাবী – শাড়ি। বাথ্‌রুমে গিজার – সিঁড়ির আলো কেটে গিয়েছিল – মিস্তিরিকে খবর দিয়ে নতুন বাল্ব … নতুন দুপাটি চটি– ভালো করে কেচে টানটান বিছানা – তুলোর মত তুলতুলে বালিসের ওয়াড়্‌ -

আজ মেয়ে বাড়ি আসছে আমেরিকা থেকে … চার বছর পর …

চার চারটে বছর … কিভাবে যে কেটে গেল!

কাল যে আবার ২৫শে বৈশাখ …

বসবার ঘরে রবীন্দ্র রচনাবলীর মুড়ে যাওয়া পাতা ঠিক করতে করতে নিজের মনেই হাসছিলেন সুহাসিনীর …

সেটাও রবীন্দ্রজয়ন্তীর দিন – তোর্ষার তখন এক বছর বয়েস – পাড়ায় চিত্রাঙ্গদা হবে – সুরূপার ভূমিকায় সুহাসিনী – সারা গায়ে ফুলের গয়না – মুখে মেক আপ … ব্যস্ততা – এর মধ্যে মেয়েটাকে নজর দেওয়া হয় নি –এর ওর কোলে কোলে ঘুরেছে অনেকক্ষন -  মাকে খুঁজেছে হাপিত্যেস – কেঁদেটেদে ঘুমিয়ে পড়েছে। নাটকের শেষে কোলে নিলেন – গলা চেনা চেনা কিন্তু অমন সাজে মা কে চিনতে পারছে না – পরে যখন বুঝতে পারলো তখন কি অভিমান ওইটুকু মেয়ের – ঠোঁট ফুলিয়ে কান্না …… শেষে অনেক করে ভুলিয়ে ভালিয়ে তবে সেযাত্রা রক্ষা …

পুরোন ছবির ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে এইসব সাতকাহন মনে পড়ে সুহাসিনীর … আজকাল এইসব পুরোন কথা খুব মনে পড়ে … রিটায়ার করার পর সারাদিন অখন্ড অবসর – সঙ্গী কিছু বই – আর পুরোন স্মৃতি …

এই তো সেদিন কলাবিনুনী করে স্কুলে ভর্তি করে দিয়ে এলেন – নতুন স্কুল ড্রেস – নতুন বই – বুকলিস্ট – ওর বাবার অকারন আদিখ্যেতা সব সামলে সুমলে পাড়ার পুজোয় বছর বছর নৃত্যনাট্য করিয়ে টরিয়ে বেশ ভালোই কাটছিলো দিনকাল। সময় না তো নদীর শ্রোত - বছর ঘুরে নতুন বছর – মেয়ে একদম মাথায় মাথায়! ক্লাস এইটের সরস্বতী পূজোয় গোঁ ধরে বসলো শাড়ি পরবে। পর্‌ - কে বারন করেছে … লালপাড় বাসন্তী রঙের শাড়ী চাই – সঙ্গে সবুজ টিপ – এলো - ফুচ্‌কা খাবার জন্য অতিরিক্ত দশটাকা – তাও হল। মাথার দুপাশে পাট করে ঝুলিয়ে দিলেন দুখানি বিনুনী – ওর বাবা আহ্লাদ করে শখের হটশট ক্যামেরায় ছবি তুললেন … পাশের বাড়ির বৌদির হাসাহাসির মধ্যেই বন্ধুদের ডাকে এক ছুট্টে বেরিয়ে গেল মেয়ে –

সাবেকি উত্তর কলকাতার বনেদী বাড়ির দোতলার টানা বারান্দা থেকে তার ছুটে যাওয়া দেখে হাসতে হাসতে শ্বশুরমশাই বলেছিলেন “বৌমা – তোমার মেয়ে বড় হয়ে গেল যে …”

বড়ই হয়ে গেল তোর্ষা – হুট করে জানান না দিয়েই। এইট থেকে টেন অবধি চেনা-অচেনার ভারসাম্যটা টলটলে ভরা পাত্রের মতো কোনওমতে সামলানো … মেয়ের সবকথা সুহাসিনী আর বুঝতে পারেন না – আর সেই না বোঝার মধ্যেই একটু একটু করে উপলব্ধি করেন যে মেয়ে আর তাঁকে সব কথা বলে না … কিম্বা বললেও ঘুরিয়ে বলে।

“কি গো – একা একা মিটি মিটি হাসছো কেন?” সুবীর যে কখন বাজার থেকে ফিরে এসেছে টেরই পান নি সুহাসিনী … ঘেমে নেয়ে একসা হয়ে দুহাতে দুটো ভর্তি থলি নিয়ে তিনতলার ওপরে।

“ও মা … তুমি এসব নিয়ে উঠলে কেন? একবার ডাক দিলে পারতে তো! মিনতিকে পাঠাতাম …”

“খুব ভালো ইলিশ পেলাম জানো – মানিকতলা বাজারে এবার অনেক ইলিশ উঠেছে।”

“তুমি সেই মানিকতলা বাজারে গিয়েছিলে? এলে কি করে?”

“বাঃ তোমার মেয়ে আসছে এতোদিন পরে … এন আর আই জামাই আর অ্যামেরিকান সিটিজেন নাতি … একটু বাজার করতে হবে না …”

“পারোও বটে তুমি … যত্তোসব …” মুখঝামটা দেন সুহাসিনী … মনে মনে অবশ্য ভালোই লাগে …

“একটু ভালো করে বেগুন দিয়ে ইলিশ করো তো … আর আলু পোস্ত। আর মিনতিকে বোলো আমাকে আর এক কাপ চা দিতে”

“মেয়ে - জামাইএর জন্য না নিজের জন্য ?” বইএর ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে হাসেন সুহাসিনী

সুবীর তখন ডুবে গিয়েছেন আনন্দবাজারের পাতায় …

মাধ্যমিকের পর কলেজে না ভর্তি করে বেথুন স্কুলেই দিয়েছিলেন মেয়েকে – বাইরে বলেছিলেন ভালো পড়াশুনো হবে তাই – আসলে ভেতরে ভেতরে বোধহয় অমোঘকে অস্বীকার করতে চাইছিলেন সুহাসিনী। আরো কয়েকটা বছরকে মেয়েকে কাছে টেনে রাখতে চেয়েছিলেন … নিজের মতো করে … কলাবিনুনীর মতন করে …

ক্লাস টুয়েল্‌ভে সরস্বতী পূজোতে যাবার সময় বলে গেল “মা আজ একটু ফিরতে দেরী হবে – বন্ধুদের সঙ্গে নন্দনে সিনেমা দেখতে যাবো”

রাগ হয়েছিল – কিন্তু বারন করতে পারেন নি … জানতেন যে বারন করে লাভ নেই – আর বন্ধুদের প্রতি বিশ্বাসও ছিল।

তারপর দেরী হওয়া শুরু হল মাঝে মাঝেই – বন্ধুরাও বাড়িতে আসতো – গান টান হত – আড্ডা হত। বুঝতেন কম সুহাসিনী – কিন্তু সদ্য বড়ো হওয়া উস্কোখুস্কো চুল ছেলে মেয়েগুলোকে দেখে ভালো লাগতো।একটা ছিল আরেক কাঠি ওপরে … ছেঁড়া জিন্‌স আর অর্ধেক হয়ে যাওয়া চটি - সময়ে অসময়ে হুকুম করতো – “মাসীমা –কলেজ থেকে এলাম – প্রচুর খিদে পেয়েছে … মাসীমা আর একবার চা হবে … লিকার - দুধছাড়া” – যেন ওর নিজেরই বাড়ি!

ওদের খিদ্‌মত খাটতে ভালো লাগতো সুহাসিনীর – পূর্ব কলকাতার নতুন ফ্ল্যাটে আর একা লাগতো না – সুবীর যে তখন ওর অফিসের কাজে রোজ দিল্লি বম্বে করে বেড়াচ্ছে আর বয়েসের চাপে ঘরবন্দী শ্বশুরমশাই।

বরং কোনও কোনওদিন ওরা না এলে ফাঁকা ফাঁকা লাগে…

“কি গো – চা হল?” সুবীরের ডাকে সাড় ফিরে এলো সুহাসিনীর …

“কি ভাবছো বলো তো তখন থেকে? সেই সকাল থেকে দেখছি বই গুছিয়ে চলেছো তো চলেইছো!” পাশে এসে দাঁড়ান সুবীর … “কি বই দেখি …”

সুহাসিনীর হাত থেকে মোটা বইটি হাতে নেন সুবীর –”গীতবিতান!”

দুজনেই হাসেন – নিঃশব্দে –

রান্না ঘরে চলে যান সুহাসিনী …

রবীন্দ্রসঙ্গীতের মধ্যে বড়ো হয়েছেন ওঁরা দুজনেই – যোগাযোগও সেই সূত্রে – সুহাসিনী যেখানে গান শিখতেন সেখান তবলা বাজাতেন সুবীর … এলাকার ইস্কুল – সবাই সবার চেনা। সেই থেকে আলাপ- প্রলাপ এবং পরে বিবাহ। উত্তর কলকাতার রক্ষনশীল পরিবারে পূর্ববঙ্গীয় কণ্যার বধূরূপে আগমন সেই প্রথম। অনেকে অনেক কিছু বলেছিলেন … কিন্তু সুহাসিনীকে পাহাড়ের মতো আড়াল করে রেখেছিলেন তাঁর শ্বশুর – বড়ো চাকরি, দেবব্রত বিশ্বাসের ঢঙে গাওয়া দরাজ গলায় গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত আর ততোধিক গলার জোরের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালসূলভ গোঁ ছিল ভদ্রলোকের। তোর্ষা যখন ক্লাস নাইনে তখন উনিই সূবীরকে ডেকে বলেছিলেন আলাদা ফ্ল্যাটের খোঁজ করতে …

সেই মানুষটার কথা আজ বড়ো মনে পড়ছে সুহাসিনীর … শেষের দিকে একা একা ইজি চেয়ারে শুয়ে থাকতেন … খবরের কাগজ এনে দিলে বলতেন …”ওটা নিয়ে যাও বৌমা – ওতে শুধু খুন খারাপি … কোনও ভালো খবর পায় না ওরা?” আর মাঝে মাঝে গাইতেন …

“পূরানো জানিয়া চেয়ো না …

চেয়ো না আমারে – আধেক আঁখির কোনে …”

“আজ বাবা থাকলে খুব খুশি হতেন জানো …” সূবীর বাজার থেকে আনা ফুলের মালাটা বাবার ছবিতে লাগাচ্ছেন …

“হ্যাঁ, নাতনী – নাত্‌জামাই আসছে… তাছাড়া কাল ২৫শে বৈশাখ”

হ্যাঁ পঁচিশে বৈশাখ ছিল ওনাদের বিয়ের দিন – বিয়ের দিন নিয়ে আদিখ্যেতা করার কেতা বনেদী বাঙালী বাড়িতে থাকে না … ওঁদেরও ছিল না … সত্যি বলতে কি শ্বাশুড়িমা বিশেষ কথাই বলতেন না – দুজনের কথা শ্বশুরমশাই একাই বলে দিতেন যে - তাই। মাঝে মাঝে গান গাইতেন – হারমোনিয়াম ছাড়া – তানপুরায় –মুক্তছন্দের গান … কি অসাধারন যে গাইতেন। বিয়ের পরে অনেকদিন ওনার কাছে গান শিখেছেন সুহাসিনী। কিন্তু বাইরে পাড়ায় নিয়ে যেতে পারেন নি … বললে উনি শুধু হাসতেন … বলতেন “রবিঠাকুরের গান কি শোনাবার জিনিস গো – এ তো নিজের সঙ্গে কথা বলা। তোমরা শুনলে – সেটুকুই থাক – বাইরের লোকের কাছে কি এই গান গাওয়া যায়?”

তখন বুঝতেন না সুহাসিনী – ভাবতেন আসলে বোধহয় শ্বশুরমশাইএর আপত্তি …

এখন একটু একটু বোঝেন …

উনি চলে গেলেন - তোর্ষা তখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ে …

সেবছর পঁচিশে বৈশাখের দিন বাবা একটা মালা কিনে এনে সুহাসিনীকে বললেন – “এই মালাটা একটু পরিয়ে দিও বৌমা”

তারপর সারাটা সন্ধ্যা একমনে কণিকা বন্দোপাধ্যায় শুনলেন … একা একা …

তার পরের পঁচিশে বৈশাখের আগেই উনিও চলে গেলেন … যাবার ঠিক আগে সুবীরকে ডেকে বললেন “মন্ত্রতন্ত্র পড়ে আমার কাজ কোরো না – আমার বড়ো কষ্ট হবে তাতে … শুধু একটা গীতবিতান রেখে দিও খাটে –আর পারলে বৌমাকে আর তোর্ষাকে কয়েকটা গান গাইতে বোলো …”

কথা রেখেছিলেন সুবীর - সুহাসিনী – বড় করে ঘটা করে শ্রাদ্ধশান্তি করেন নি – সামান্য কয়েকজনকে নিয়ে ছোট করে … সেদিন অনেক গান গেয়েছিলেন সুহাসিনী – তোর্ষাও …

তারপর প্রত্যেক পঁচিশে বৈশাখ সন্ধ্যায় বাড়িতে একটা ছোট গানের অনুষ্ঠান করেন সুহাসিনী – ঠিক রবীন্দ্রজয়ন্তী নয় – সুবিমল, কমলদা, সুচিত্রা বৌদি এইরকম কিছু কাছের মানুষ আসেন – সবাই মিলে গান হয় –একটা দুটো কবিতা পড়া হয় সঞ্চয়িতা থেকে –।

ওরকম এক রবীন্দ্রজয়ন্তীতেই নিরূপমের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল তোর্ষার – নিরূপম সুবীরের কলেজের বন্ধু সুবিমলের ছেলে – ভদ্র, নিয়মনিষ্ট, পাট করে চুল আঁচড়ানো। সুবিমলদারাও খুব শান্ত – সহজ মানুষ – সহজেই কাছের মানুষ হয়ে পড়েছেন। তাই কোনওপক্ষেই আপত্তি হয় নি … বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সম্পর্ক আরো গাঢ় হয়েছে … সপ্তাহে একদিন ফোনে কথা হতেই হয় দুই বাড়িতে … লিপিকাদি খুব ভালো আবৃত্তি করেন …

তোর্ষা খুব ভালো গাইতো – গলা ছিল গানের – বোধহয় সূবীরের মায়ের কাছ থেকে পেয়েছিল।

“রান্না বান্না আজ হবে না – না কি?” সুবীর তাড়া দেন … “না কি সমস্তদিন ধরেই ঘর গোছাবে?”

সম্বিত ফিরে আসে সুহাসিনীর … দ্রুতপায়ে রান্না ঘরে চলে যান …

সমস্তদিন নিজেকে আছ্‌ড়ে পিছ্‌ড়ে কেচে ইস্তিরি করে তৈরী করেছেন সুহাসিনী –

তোর্ষা আসবে আজ সন্ধ্যায় – মেয়ে জামাই – নাতি –ওনার কাছে থাকবে –কত গল্প করবে – ওদের আমেরিকার গল্প –চাকরির গল্প …

তারপর কাল সবাই মিলে বৈতালিকে – বিকেলে বাবা-মায়ের ছবির সামনে বসে তোর্ষার গান – কতোদিন বাদে – কাউকে বলেন নি – বেশ একটা সারপ্রাইজ দেওয়া হবে …

দুপুর দুটো নাগাদ ফোনটা আসে … তোর্ষার – সুবীরই ধরেন …

“বাবা – আমি তোর্ষা …”

“হ্যাঁ – বল্‌ - তোরা কখন বেরোচ্ছিস? সেই বেহালা থেকে তো আসতে সময় লাগবে …”

“শোন না – আজ যেতে পারছি না গো … আসলে হঠাৎ ঠিক হল – আমরা আজকেই পুরী যাচ্ছি …”

“পুরী !!!”

“হ্যাঁ – ওর নিউ জার্সির একজন বন্ধুও এখন কলকাতায় এসেছে – সো উই অল আর গোয়িং টুগেদার …হঠাৎই ঠিক হয়ে গেল”

“কিন্তু …”

“আমরা ডে আফটার পরশু ফিরবো …”

“হ্যাঁ – কিন্তু এতো অল্প সময়ে রিজার্ভেশন – হোটেল …”

“সব হয়ে গেছে … ইন্টার্নেটে টিকিট আর হোটেল দুই-ই বুক হয়ে গেছে … আমরা রাতের পূরী এক্সপ্রেস ধরছি – দশটার সময়”

“তাই –  আমরা স্টেশনে আসবো? দাদুভাইয়ের সঙ্গে একটু দেখা …”

“বাবা … তুমি যে কি না। না – অতো রাতে তোমাকে আর সেই সল্ট লেক থেকে হাওড়া স্টেশন আসতে হবে না …। আমরা তো ফিরে এসে তোমাদের ওখানে যাবোই দু এক দিনের জন্য”

“ওঃ – আচ্ছা – তুই একটু মায়ের সঙ্গে কথা বল …”

“আর মার সঙ্গে কি কথা বলবো … এক্ষুনি বেরোতে হবে। তোমাদের ট্রেন থেকে ফোন করবো – ওকে …”

“ট্রেন থেকে … ও আচ্ছা ঠিক আছে … সাবধানে যাস – সাবধানে থাকিস তোরা …”

“ওকে – বাইইইইই”

ফোন রেখে দেন সুবীর … সুহাসিনীর দিকে ফেরেন। আঁচলের প্রান্তটা এখন সুহাসিনীর আঙুলে জড়ানো …

“ওরা পূরী …”

“বুঝেছি …” অদ্ভুত শান্ত গলা সুহাসিনীর … “যাও তুমি স্নান করে নাও – আমার রান্না হয়ে গিয়েছে”

“হ্যাঁ যাই …” অসুস্থ মানুষের মতো উঠে পড়েন সুবীর – স্নানঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেন …

সুহাসিনী তখন ভেতরের ঘরে … জানলার ধারে … পুরোন চিন্তাগুলো সব জট পাকিয়ে যাচ্ছে – কিছুতেই খুলতে পারছেন না …

হঠাৎ মনে হল ছবির মধ্যে থেকে সদাহাস্যময় শ্বশুর মশাই বলছেন …

“তোমার মেয়েটা যে বদলে গেল বৌমা – একদম বদলে গেল”

তারপর চেনা গানটা আবার শুরু করলেন আবার …

“মাধবীকুঞ্জ বার বার করি

বনলক্ষীর ডালা দেয় ভরি

বার বার তার – গান মঞ্জরী

নব নব ক্ষণে ক্ষণে –

পুরানো জানিয়া চেয়ো না

চেয়ো না আমারে – আধেক আঁখির কোনে…”

সেই নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় টিভি চলে না বাড়িতে … ঘরে চুপ করে বসে ছিলেন সুহাসিনী।

সূবীর এসে ডাকেন … “কি গো … চলো ছাদ থেকে একটু হেঁটে আসি”

ইচ্ছে করে না – তবু ছাদে যান … একসঙ্গে পায়চারী করেন – বৈশাখের বাতাসহীন সন্ধ্যায় বলার মতো কথা হারিয়ে যায় …

“ভেবো না সূ – ছেলে মেয়ে বড়ো হলে একটু বদলে যায় …” সুবীর স্বান্তনা দেন।

উত্তর দেন না সুহাসিনী …

“আর এতোদিন বাদে দেশে এসেছে – ওদের কি আর এই বুড়োবুড়ির সঙ্গে বসে বসে গল্প করতে ভালো লাগে বলো? তাই একটু বেড়াতে …” সুবীর কথার জাল বোনেন … অন্যদিনের মতো ঠিক জমে না আজ … চুপ করে যান।

“আচ্ছা সূ, তোমার মনে আছে – তুমি একসময় আবৃত্তি করতে …?” নৈঃশব্দ ভাঙেন সুহাসিনীই

“হ্যাঁ … কিন্তু সে তো অনেক দিনের কথা … আর তেমন ভালো তো করতাম না ”

“আমাকে আর একবার শোনাবে সূ … যেমন সেইবার বসন্তোৎসবের পরের দিন পার্ক গেস্ট হাউসের বারান্দায় বসে শুনিয়েছিলে ?”

“পার্ক গেস্ট হাউস … সে তো অনেক দিনের কথা - তোমার মনে আছে সূ?”

“মনে থাকবে না … সেদিন সারা সন্ধে বৃষ্টি হয়েছিল আর আমরা বাইরে বেরোতে পারি নি। ”

“হ্যাঁ – গীতবিতানের পাতা ধরে ধরে পর পর গান গাইছিলে তুমি”

“কারন তুমি বাজি ধরেছিলে যে এমন কোনও একটা পাতা থাকবেই যার একটা গানও আমার জানা নেই …”

“বাজিটা তুমিই জিতেছিলে সূ …”

“আর সেই রাত্রেই তোর্ষা …”

ছাতের আলো অন্ধকারে পুরু চশমার ছাঁউনিতে দিয়ে পাকাচুল দুটি মানুষ এইভাবে গল্পে মেতে ওঠেন … দূর থেকে অস্ফুটে ভেসে আসে রবীন্দ্রজয়ন্তীর রিহার্সাল … পাশের বাড়ির টিভিতে “তিথির অতিথি” আর রাস্তার মধ্যিখানে পথ হারানো একমাথা চুল নিয়ে একখানি অশ্বথ্ব গাছ …

কথায় কথায় অনেক রাত হয়ে যায় – প্রায় মধ্যরাতে বত্রিশ বছরের চেনা সংসারী বিছানায় শুয়ে খোলা জানলার দিকে তাকিয়ে সুহাসিনী বলেন …

“আচ্ছা সূ … কমলদার ইষ্কুলে আমাকে একদিন নিয়ে যাবে? উনি বলছিলেন না যে ওই ছেলে মেয়েগুলোকে গান শেখানোর লোক দরকার …”