এই পথ তেপান্তরে যায় …

কেউ পৌছতে পারে – কেউ পারে না …

কাঁচের মতো স্বচ্ছ হাডসনের ভেতর দিয়ে ছুটে চলেছে এক ট্রেন মানুষ … সাদা, কালো, খয়েরি রঙের মানুষ … গায়ে গা ঘেসে পায়ে পা মাড়িয়ে মনে মন ঠেকিয়ে সকলের মধ্যে একদম একা একা অনেক মানুষ – ঘড়ির কাঁটা ধরে আকাশের দিকে উঠে যাওয়া এস্কেলেটরের প্রতিটি পাদানীতে ক্ষণজন্মা জীবনবোধ – সভ্যতার অহংকার।

একটু পরেই অট্টালিকা জঙ্গলের সামনে এসে দাঁড়াবে এক অক্ষৌহিনী আকাশচুম্বি স্বপ্ন – শিকারের খোঁজে হারিয়ে যাবে বনের গহীনতম কোনে … ধাক্কা মারবে চেনা ও অচেনা সমস্ত বন্ধ দরোজায় … যদি পড়ে পাওয়া যায় সোনার কাঠি কিম্বা রাজকণ্যার খোঁজ!

এইভাবে যে শহর ঘুমোয় না তার ঘুম ভাঙে …

আমি এসে দাঁড়াই উঁচু বাড়িটার সামনে … বত্রিশ তলায় বৈদ্যুতিক রোদঝলমলে দশ বাই সাড়ে সাত কিউবে সংসার … ই মেলের নিশ্চিন্ত আড়ালে দৈনিক যাপন সঙ্গীত শুরু হয়। আলো নিভে যায় … ঠোঁটে কড়া কফির আস্বাদ … সোনার হরিনী কলিগের চঞ্চল পদচারনা … টার্গেট – মিটিঙ – স্ট্রেস - টেনশন … লাঞ্চে সুসি – স্ন্যাক্সে স্টার বাকস … সামারে বার্বিকিউ – সুপারবোল বিজ্ঞাপন আর ক্রিসমাস শপিং - অর্গানাইজেশনাল বিহেভিয়ারের সমস্ত আহ্লাদ জমে ওঠে কম্পিউটার স্ক্রিনের আনাচে কানাচে …

মাঝে মাঝে নিচে নেমে রাস্তায় একটু হেঁটে বেড়াতে মন্দ লাগে না … এখন শীতকাল … হু হু করে বইছে ঠান্ডা হাওয়া … বিলো জিরো টেম্পারেচার … ওদিকে চড়া রোদ্দুর … ফুটপাথের একপাশে গত সপ্তাহের জমে যাওয়া স্নো – লোকের পায়ে পায়ে রঙবদলে কালচে হয়ে গেছে … অফিস বিল্ডিঙের পেছনের গলিতে জঞ্জালের ভ্যাটের ওপর পুরু বরফের স্তর … বিশ্রী গন্ধ … তার মধ্যে একজন লোক খুঁজে চলেছে অতি প্রয়োজনীয় বর্জ্য পদার্থ  … বাইরে তার পার্টনার … কুড়িয়ে নিচ্ছে ফেলে দেওয়া সিগারেটের টুকরো … রেখে দিচ্ছে বাহারি এক চামড়ার ব্যাগে … ওর টার্গেট এখোনো কমপ্লিট হয় নি … পাশের বিল্ডিঙের ভ্যাট টা এরপর ওর নেক্সট স্টপ …

শস্তা সিগারেটের আর জঞ্জালের বমি ওঠা গন্ধের মধ্যে সভ্যতার এই আদিম রূপ মিষ্টি রোদের মত জানলার কাঁচে লেগে থাকে …

আমি এসে দাঁড়াই চওড়া রাস্তাটায় … বিশ্ববিখ্যাত অপেরা হাউসের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে শ্রোতের মত লোক … কিছু টুরিস্ট … কিছু ফড়ে দালাল আর ফুটপাথে অনেক ফিরিওলা… ভাঙা ইংরেজী – আরো ভাঙা চোয়াল … শুকনো ঠোঁট … ছিঁড়ে যাওয়া একটামাত্র জ্যাকেট … দুটো “আই লাভ নিউ ইয়র্ক” পনের ডলার … ক্যাশ ক্যাশ … ওপাশে আবার বেহালার ছড়ে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক্‌ চেনা – অচেনা ক্রিসমাস ক্যারল।

রাস্তা পেরিয়ে অন্যপারে হটডগ আর চাইনিজ্‌ ফ্রায়েড রাইসের দোকানে লাইন … শহরে এখন দুপুর … মধ্যরাত্রে শ্বাপদ যেমন জলের কাছে আসে … চেটে নেয় নুন … তেমনই জৈবিক প্রয়োজনে কিছুক্ষন মুলতুবি রাখতে হয় স্বপ্নের সুলুকসন্ধান। তারপর নেকড়ের যেমন শিকারকে টেনে নিয়ে যায় তার আস্তানায় তেমন ঠোঙায় ঝুলিয়ে নিয়ে বত্রিশ তলার নিভৃত নিরাপদ কোন …

আর মাঝে মাঝে কোন কোন দিন কারো সাথে আলাপ হয়ে যায় … বলে ‘চলো সেন্ট্রাল পার্কে একটু বেড়িয়ে আসি .. কিম্বা মিউসিয়মে … নিদেন পক্ষে দুটো বাড়ির ফাঁক দিয়ে লুকিয়ে চুরিয়ে এসে পড়া রোদ্দুরের মধ্যে গিয়ে দুদন্ড দাঁড়াই”

না করতে পারি না … লোকের ঠেলাঠেলির মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে তার নাম বলে  – শুনতে পাই না … শোনার প্রয়োজনও দেখি না বিশেষ। শুধু তার সঙ্গে সঙ্গে কোনমতে দৌড়োদৌড়ি করে পার্কের কাছে গিয়ে পৌঁছই। পার্কের সবুজের মধ্যে তখন কিছু বৃদ্ধ বৃদ্ধা আর মিলিওনয়রের নিত্তনৈমিত্তিক পদচারনা।

আমরা একটি বেঞ্চে গিয়ে বসি … হঠাৎ কোলাহল কমে আসে … শীতের নরম রোদ্দুর পাতার আড়াল দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে নেমে আসে আমাদের গায়ে হাতে পায়ে … ও আমাকে গল্প বলে … ওর ছোটবেলার গল্প … ওহায়োর ফার্মে ওর বাবা মায়ের গল্প … ভাইবোনের গল্প … ওদের ছোট্ট শহরের গল্প … হেঁসে বলে “জানো আমাদের শহরটা ছিলো সত্যিকারের স্মল টাউন … একটা মেন স্ট্রিট - দুটো রেডলাইট – একটা গ্যাস স্টেশন আর একটা গ্রসারি কাম কনভিনিয়েন্ট স্টোর”

“লোকজন?”

“মেরেকেটে একশো … না একশো ফ্যামিলি না … একশো লোক .. প্রায় সবারই ফার্ম – গরু, শুওর এইসবের – আমার ছোট ভাই এখনো ওখানেই…”

“তাহলে তুমি চলে এলে কেন?”

“কলেজে যাবার পর থেকেই সব বিচ্ছিরি লাগতো… সবাই চেনা – সবাই সবাইকে চেনে – বৈচিত্রের দৌড় মাত্র একটা ব্লক … তারপর সেই এক চর্বিত চর্বণ। ওদিকে কলেজে তখন কতো এক্সাইটমেন্ট … তাই আমরা দুজনেই প্ল্যান করলাম নিউ ইয়র্কে মুভ করবো … ”

“তারপর …”

“তার পরও শুনতে চাও … তাহলে তো আর অফিস যাওয়া হবে না …”

বত্রিশ তলার নিরবিচ্ছিন্ন শান্তির কোনটা মাথায় একবার ঝিলিক দিয়েই লুকিয়ে পড়ল …

“সে ঠিক আছে … তুমি বলো তো …”

“তার পর আর কি … নিঊ ইয়র্কে মুভ করলাম … আপটাউনে ঘর নিলাম দশ তলায় … আমাদের দুজনের অ্যাপার্টমেন্ট … শুধু দুজনের … মাস কয়েক যে কোন সুখের জোয়ারে ভেসে বেড়ালাম তা আর বলার নয়।

কিন্তু ক্রমশঃ পকেটে টান পড়ল … এবার কাজ খোঁজা দরকার  …”

“উ হুঁ”

“আমি চাকরি পেলাম ওয়াল স্ট্রিটে – আর ও স্টেট –এ। আর তার পর কেমন যেন সবকিছু হতে শুরু করলো … সময় বড়ো কমে গেল … দিনে মাত্র কয়েক ঘন্টা দেখা হতো … তাতেও অফিসের কাজ …।”

“তারপর ?”

 “যা হবার তাই হলো … এক সামার জুলাইতে আমরা আলাদা হয়ে গেলাম … ও এখন কুইন্সে মুভ করে গেছে আর আমি এক অ্যাপার্টমেন্টেই থাকি ”

“তারপর …?”

“আর কি … সোনার তাল খুঁড়ে আনছি ওয়াল স্ট্রিটের অন্ধকার থেকে … রোজ – ২৪/৭ – হাই সিক্স ডিজিট ইনকাম … মাঝে মাঝে ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড … এই বেশ ভালো আছি …”

ওর সোনালী চুলের মধ্যে তখন শেষ বিকেলের চোরা রোদ … চোখের পাতায় একসমুদ্র দীর্ঘশ্বাস … দৃষ্টি অন্যাদিকে ফেরানো … মনের অসুখ লাগামছাড়া …

আমি জিজ্ঞেস করলাম … “সত্যিই ভালো আছো?”

ও হেঁসে বলল “চলো ফেরা যাক …”

এইভাবে বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা নামলো… এক অক্ষৌহিনী সৈন্যদলের সঙ্গে আমিও শিতঘুম ঘুমাতে বাড়ি চললাম … পড়ে থাকলো কিছু পায়ের এবড়ো খেবড়ো ছাপ, জঞ্জালের ভ্যাটের নির্জন আশ্রয়ে জুবুথুবু কয়েকটি প্রান, এক সোনালী চুল অসুখী মন … খালি হয়ে যাওয়া সিগারেট প্যাকেট,  দু এক ফোঁটা পানসে হয়ে যাওয়া রক্তের দাগ … আর টাইম্‌স স্কোয়্যারের মিলিয়ন ওয়াটের ন্যাসড্যাক নিওন

তারপর পেন স্টেশন … নিউ জার্সি ট্রান্‌জিটের একঘেয়ে সাদা, কালো খয়েরি পথচলা … বাড়ির মতন কোথাও ফিরে চলা …

ফেরবার পথে দেখলাম সারারাত প্রদীপ জ্বেলে বসে আছে স্ট্যাচু অব লিবার্টি শহর,

যে সোনালী চুলেরা রোজ পথ ভূল করে এই তেপান্তরের মাঠে চলে আসে – তাদেরকে বুকে টেনে নেবার জন্য…

এই পথ তেপান্তরে যায় … কেউ পৌছতে পারে – কেউ পারে না …

আর আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি মেঘ করেছে – একদম ধুসর আকাশ … হাডসনের তলায় নেমে যাবার আগে গলা ছেড়ে গাইতে ইচ্ছে করছিল … “ম্যাঘ রাজা রে … তু সুদর ভাই / এক ঝুড়ি ম্যাঘ দে – ভিজ্যা ঘরে যাই …” …