পাপ জম্ছে রাস্তায় – হাতে পায়ে মাথায় যেমন ভোরবেলার শীত জমে থাকে – তেমন পাপ ..
ফুটপাথ জোড়া করে বসেছে পাপের বেসাতি … সিনেমাহলের সামনে প্রকাশ্যে চলছে দরদাম … যেন মাছের বাজার … রিকশার টুংটাং - পাশে গলির মধ্যে সভ্যতার শান বাঁধানো ঘাটে বিক্রি হচ্ছে নিষিদ্ধ উপন্যাস কিম্বা আরো নিষিদ্ধ টুকরো মুহূর্ত … আর মাছির মতন ভন্ভন্ করছে সদ্য গোঁফওঠা কয়েকটি তাজা শরীর … এবং আরো অনেক মধ্যবয়েসী পোড়খাওয়া ক্ষয়াটে ভাঙা চোয়াল। অন্ধকার গলির কোনে সপ্তাহের হিসেব মিলিয়ে নিচ্ছেন পার্টির দাদারা … আর আরো ভেতরে … এলাকার অন্দরমহলে পুরোন ভাঙ্গাচোরা বাড়িটা তার শতবার্ষিকী পালন করছে লালসায় পুড়ে যাওয়া আইটেম গানের বিভঙ্গে …
একটু দূরে … অন্য ফুটপাথে জমে উঠেছে শব্দদূষণ - সিঙ্গুর-বাঙ্গুর-নন্দী-ভৃঙ্গীগ্রামের বিতর্ক … তান্ত্রিক, গনতান্ত্রিক এবং জনগনতান্ত্রিক স্বপ্ন বিলোচ্ছেন ঘোলাটে চশমা নেতা ও নেত্রী। তিনতলার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে চলছে রাজনৈতীক কাটাছেঁড়া –… অনশন এবং মিডিয়া কভারেজের তুল্যমূল্য হিসাব …
পায়ে পায়ে বহুতল বাড়িটার সামনে … পায়রার খোপ স্বপ্ন … পায়রার খোপ বানিজ্য – পায়রার খোপ কমিশন … সেলফ এল্পময়মেন্ট … সেলফ সাফিসিয়েন্ট … এক্ষুনি চাই … আজকেই চাই … পারলে চাঁদ না পারলে নেহাৎ কিছু রক্তমাংশের আস্বাদ … যা চান তাই পাবেন স্যার … শুধু আজকের দিনটা অপেক্ষা করুন … মনটাকে লালদীঘির রয়্যাল ব্লু জলে ঢেলে দিয়ে আসি …
এবং ওপারে লাল বাড়ি লালে লাল … আসুন – গল্প করুন – টোয়েন্টিনাইন-ব্রিজ-ক্যারম টুর্নামেন্ট চলুক – কিম্বা সাইডে এল আই সি আর মিউচুয়াল ফান্ডের দালালী … ঘন্টায় ঘন্টায় চা … নিয়ম করে মোহনবাগান মাঠে হাজিরা … শুধু কাজ করতে বললে আর কম্পিঊটার বসলেই রাগ … অভিমান … “দাদা – শ্রমিকদরদী সরকারের এই রূপ?” … আর তারপর স্বরূপ … “ঠিক আছে শালা – কোয়াপরেটিভ ইলেকশন তো সামনে … তখন দেখে নেব …।” আর সন্ধ্যায় ভিড় মিনিবাসের মধ্যে নিত্য সহযাত্রীনিকে অভ্যাসবসতঃ ঝারি করতে করতে দীর্ঘনিঃশ্বাস মোচন … “সোসাইটি হলটা পুড়ে গেল মাইরি… !!!”
ভাঙা ট্রামের শব্দ, মাইকের আওয়াজ, পুলিশের মানুষের অমানুষের দীর্ঘশ্বাস, জীবনের যাঁতাকলে পিষতে থাকা মানুষের আর্তনাদ – পাপ-অপাপের এইসব টুক্রো অংশগুলি মিলে মিশে এক ধাতব বেদনায় শহরের চোখে জল আসে …
আর ঠিক এই সময় কাক্তালীয় কিম্বা বলি/টলিঊড গল্পের গরুর আদলে ঘটনাগুলো ঘটে … ঘটে যায়
তেত্রিসে পা দেওয়া সরকারী কর্মচারী সিঞ্চন বিকেল সাড়ে চারটেয় অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ে পাঁচটা বত্রিসের ব্যারাকপুর লোকাল ধরবার জন্য … সন্ধেবেলা আবার কোথায় যেন যাবার আছে। দ্রুতপদে ধর্মতলা স্ট্রিটের দিকে হেঁটে চলেছে। সারা অফিসপাড়া এখন অচল … কারন একটি মিছিল। আর মিনিট দশেক আগে অব্দি তাতে শ্লোগান দিচ্ছিল সিঞ্চনের ছোটবেলার ক্লাসমেট স্বায়ন্তন … জিন্স, আধ্ময়লা পাঞ্জাবী আর শান্তিনিকেতনী ব্যাগ ভূষিত হয়ে সর্বহারার প্রতিনিধি সে এখন পার্টির জেলা কমিটির হর্তাকর্তা। মিছিল এখন মঞ্চের নেতার ভাষন শুনতে কিম্বা নিজের নিজের কাজে ব্যাস্ত – আর ও মোড়ের দোকান থেকে সিগারেট কিনছে। আর একই সময় সুসজ্জিত টয়োটা ইনোভাতে বসে কলকাতার দুরবস্থার কথা ভাবছিল সার্থক। গতকাল রাত্রি দুটোয় ওর ফ্লাইট লস এঞ্জেল্স থেকে কলকাতায় নেমেছে – আগামীপরশু উড়ে যাবে ডারবান অভিমূখে … সামনেই “ডিউক” – সেখান থেকে রাতের খাবারটা তুলে নেবে কি না ভাবছিল সার্থক – ডিউকের বর্তমান মালিক ওদের পুরোন বন্ধু সোহম – বাবার মৃত্যুর পর থেকে ওই দোকানের দেখাশুনো করে।
কয়েকশো ফুটের মধ্যে চলমান চারটি চেনা জীবন ঘুরে বেড়াচ্ছিল – যেমন হয়তো প্রায়ই বেড়ায় … দেখাসাক্ষাত হয় না …
কিন্তু ঠিক সেই সময় সম্পুর্ন অপরিচীত এক যুবক কোনও একজনের পকেট মারছিল এবং দূর্ভাগ্যবসতঃ ধরা পড়ে যাচ্ছিল। ফলতঃ সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ এর মোড় জুড়ে একটা দৌড়োদৌড়ি … হূটোপুটি … ছেলেটি দৌড়ে পালাচ্ছে – পেছনে অক্লান্ত জনতা এক্সপ্রেস। এই দৌড় এ ওলটপালট হয়ে করে দেয় ষাটোর্ধ দোর্দন্ডপ্রতাপ অঙ্কের শিক্ষক কালিপদ চৌধুরির দৈনন্দিন রুটিন – এখনো শরীরে এতটুকু মেদ নেই, বয়সের ছাপ বাইরে পড়তে দেন না – রিটায়্যার করার পর নিয়মিত ন্যাশনাল লাইব্রেরি যান – সন্ধ্যার মুখে চাঁদনী থেকে মেট্রোয় উঠে শোভাবাজার নেমে হেঁটে বাড়ি …
কিন্তু উর্ধশ্বাসে ছুটতে থাকা পকেটমারের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে মাটিতে ছিটকে পড়েন কালিপদবাবু – যে দোকান থেকে স্বায়ন্তন সিগারেট কিনছিল তার ঠিক সামনে … যখন সেখান দিয়ে সিঞ্চন রাস্তা পেরোচ্ছে ঠিক তখন।
বলাই বাহুল্য এই সূত্রে দেখা হয়ে যায় চারজনের … এবং কালিপদবাবুর – কেননা তিনি ছিলেন এঁদের শিক্ষক।
“ডিউকের” ভেতরে দোতলায় নিয়ে বসানো হয় মাষ্টারমশাইকে … প্রয়োজনীয় এবং অপ্রয়োজনীয় নানা কেতাদুরস্ত কথা বার্তা– চিকিৎসার বিধান ইত্যাদি। কুশল সংবাদ … ইত্যাদি।
কথায় কথায় ডাক্তারের আগেই কালিপদবাবুর জ্ঞ্যান ফিরে আসে … চারজনেই মাস্টারমশাইকে তাঁদের পরিচয় জানায়। কালিপদবাবুর আবছা মনে পড়ে … অথবা পড়ে না – পড়ার কথাও না … প্রতিবছর প্রায় শ-খানেক ছেলে - কুড়ি বছর ধরে – কারুকে আলাদা করে মনে রাখা খুব কঠিন। আবার মনে নেই বললে সবার মুখ ভার হয়ে যায় … তাই চেনার ভান…
তবে আলাদা করে চেনার খুব দরকারও হয় না। সবাই অল্প-বিস্তর প্রতিষ্ঠিত – কিম্বা অপ্রতিষ্ঠিত - সবাই অল্প বিস্তর সুখে দুঃখে আছে – ভালো-মন্দ মিলিয়ে মিশিয়ে জীবনের পাঁচফোড়নের স্বাদ – প্রায় সবাই খুব সাধারন। এঁদের সঙ্গে দেখা হলে সাধারনতঃ বেশ ভালো লাগত কালিপদবাবুর … নিজের অতীতের কর্মোজ্জ্বল দিনগুলির কথা মনে পড়ত … গর্বে বুক ভরে উঠত। যেমন গর্বে বুক ভরে উঠত তাঁর নিজের সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে … যখন ও ছোট ছিল – তখন। মনের সুখে তাঁকে বড় করেছিলেন – এতটুকু আঁচড় লাগতে দেন নি কোনওদিন – সব দুঃখ থেকে আড়াল করে রেখেছিলেন … মনে মনে আশা করেছিলেন যে সে একটি অসাধারন মানুষ হয়ে উঠবে …
“এখন কেমন লাগছে কালিদা?” একটি মুখ জিজ্ঞেস করে …
“একটু জিরিয়ে নিন …” আরেকজন ফতোয়া জারি করে …
“কেন যে বেরোন – বয়ষ্ক মানুষের জন্য কলকাতা আজকাল যে কি ভয়ানক …” আরেকজন নিদান হাঁকে …
“আর একটু গরম দুধ আনতে বলি?” একজন উদ্বিগ্নভাবে জিজ্ঞেস করে …
মাথা নেড়ে বারন করেন কালিপদ … আজকাল এঁদের দেখলে সেই আনন্দ আর হয় না … ছেলে বড় হল – এঁদের মতোই প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করলো – বিদেশে গেল। যত সময় গড়াল – ততো যেন কেমন অচেনা হয়ে যেতে লাগলো – একরত্তি সেই মাংশপিন্ডটা – হাসপাতাল থেকে যাকে কাপড়ে মুড়ে নিয়ে এসেছিলেন – কোলের একপাশে ধরে যেত … রাত্রিবেলা মাঝে মাঝে উঠে দেখতেন – ছোট্ট মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকতেন নির্নিমেষে… ছোট ছোট আঙ্গুলগুলো ধরে খেলা করতেন।
একসময় সেই মুখ বদ্লে গেল … সেই মুখের ভাষা, চামড়ার ভাঁজ এবং চোখের দৃষ্টি বদ্লে গেল – তাতে অবাক হলেও খারাপ লাগে নি কালিপদর – যুক্তি দিয়ে বুঝেছিলেন যে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রতিষ্ঠা নিয়ে এলো এক অদ্ভুত উদাশীনতা এবং আত্মম্ভরিতা। কিছুতেই আর কিছু যায় আসে না … ইশকুলে পড়াবার সময় এই ধরনের আত্মকেন্দ্রিক ছেলেদের একদম পছন্দ করতে পারতেন না কালিপদ … কিন্তু নিজের ছেলেই যে …
ধীরে ধীরে উপলব্ধি করলেন যে তার ছেলে আসলে খুব সাধারন … শৈশব থেকে কৈশোর এবং তারপর যৌবনের শুরুর দিকেই অসাধারনত্বের অবলুপ্তি … চারপাশের অনেক ছেলেমেয়ের ভীড়ে আর তাকে আলাদা করে চেনা যায় না …
বিদেশে পাকাপাকি থাকবার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবার পরে আজকাল একধরনের দুঃখ হয় – অক্ষমতা – অব্যক্ত যন্ত্রনা … ফিরে আসতে বলতে মন চায় কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারেন না … হয়তো মনে মনে জানেন যে এখন আর বলে লাভ নেই …
“এইবার বাড়ি যেতে পারবেন কালিদা? আমার গাড়িতে আপনাকে নামিয়ে দিতে পারি …”
“নাঃ – তার দরকার হবে না … মাথাটা একটু ঘুরে গিয়েছিল … তোমাদের ধন্যবাদ”
“কি যে বলেন কালিদা …” সবাই হাঁ হাঁ করে ওঠে …
“আজ তাহলে উঠি … তোমাদের সকলের ভালো হোক …”
একজন হঠাৎ ঢিব করে একটা প্রণাম করে ফেলে … দেখাদেখি মুখ রক্ষার খাতিরে অন্যেরাও …
প্রণাম করলে ভালো লাগে কিন্তু কি আশির্বাদ করবেন বুঝতে পারেন না কালিপদ। আজকাল এদের মধ্যে এক ধরনের পাপ দেখতে পান কালিপদ … আত্মকেন্দ্রিকতার পাপ … পাশের লোকটার নাড়িনক্ষত্রের খবর আছে, মুড়ি তেলেভাজা দিয়ে মেখে বৈকালিক চায়ের সঙ্গে তারিয়ে তারিয়ে কেচ্ছা করতে উৎসাহ আছে – কিন্তু কোনও দরকারে কাজে লাগার ইচ্ছে নেই। এরা সাধারন – এতোটাই সাধারন যে নিজেদের সাধারনত্ব নিয়ে কোন অনুশোচনাও নেই
“শিক্ষিত হও” – আশির্বাদ করেন ষাটোর্ধ বৃদ্ধ – তারপর দোকান থেকে বেরিয়ে দৃপ্ত পায়ে চাঁদনি স্টেশনে নেমে যান … পেছনে পড়ে থাকে এক শেষ বিকেলের দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হয়ে ওঠা বয়ষ্ক ছায়া …
চারজন মধ্যবয়ষ্ক জীবিত মানুষ আরো কিছুক্ষন বসে থাকে … দু এক পাত্র পান হয় … অকস্মাৎ দেখা হওয়ার উষ্ণতায় নিজেদের সেঁকে নেওয়া … আলোচনা হয় ইশকুলের দিনগুলো নিয়ে …দেখা যায় সকলেই সকলের খবর রাখে … কে কোথায় কি করছে ইত্যাদি …
তারপর একসময় এক এক করে সকলে বাড়ি ফিরে যায় … কয়েক ঘন্টার বিশ্ময় আর আকস্মিকতা কাটিয়ে দৈনন্দিন পাপে লিপ্ত হয় ওরা … জৈব, অজৈব, আর্থিক ও পরমার্থিক পাপে …
তবু বাড়ি ফেরবার পথে এক নিঃশব্দ মুহূর্তে ভূলে যাবার আগে শেষবার কালিপদদার মুখটা মনে পড়ে যায় … সমস্ত পাপের অহংকারের মধ্য দিয়ে বৃদ্ধ মানুষটির শীর্ণ কন্ঠস্বর … “শিক্ষা মানে চিন্তার স্বচ্ছতা – তোমরা শিক্ষিত হও” …
শহরে এখন বন্যার মতো পাপ জমেছে … ভরে গিয়েছে গলিঘুঁজি – গায়ে মাথায় হাতে কুয়াশার মতো লেগে রয়েছে সাদা সাদা ফেনার মতো পাপ … কান পাতলে তবু শোনা যায় … ফুটপাথে চাপচাপ রক্ত – রসুনের গন্ধ আর রজনীগন্ধার স্টিকে মোড়া গুমরানো শহরের শিকড় থেকে ভেসে আসছে বৃদ্ধের শীর্ণ অপাপবিদ্ধ কন্ঠস্বর - “শিক্ষা মানে চিন্তার স্বচ্ছতা - তোমরা শিক্ষিত হও” …